আমেরিকায় আইনে উচ্চ শিক্ষা
-মু. নুর উদ্দিন আপেল, ওহাইও স্টেট ইউনিভার্সিটি, যুক্তরাষ্ট্র
আমাদের দেশের আইন ও আমেরিকার আইন পদ্ধতি ব্রিটিশ কমন ল এর অনুসারী হওয়ায়, ব্রিটেনে গিয়ে বার এট ল করে ব্যারিস্টার হওয়া আর আমেরিকায় গিয়ে এটর্নি এট ল হওয়া সম পর্যায়ের। বরং আমেরিকায় এটর্নি এট ল হতে পারলে সুযোগ সুবিধা দুটাই বেশি বৈ কম নয়। আর আমেরিকার পড়ার পদ্ধতি, পড়াশোনার খরচ দুটাই উচ্চতর। আসুন কিভাবে আমেরিকায় আইনে উচ্চ শিক্ষা নেয়ার পথ অনুসরণ করা যায় তার একটা রোডম্যাপ তৈরি করি।
আমেরিকায় আইন পড়ার ৩ টা ধাপ রয়েছে। প্রথমত: JD (জুরিস ডক্টর) করা। JD করতে গেলে শর্ত হচ্ছে একটা অনার্স ডিগ্রি থাকতে হবে এবং LSAT তথা ল স্কুল এডমিশন টেস্ট দিয়ে প্রয়োজনীয় নাম্বার নিয়ে ল স্কুলে আবেদন করে ভর্তি হওয়া। পৃথিবীর সর্বাপেক্ষা কঠিন ভর্তির পরীক্ষার একটা এটি। বাংলাদেশ থেকে JDর আবেদন বা প্রসেসিং সম্ভব না। বিশ্বের ১৪০ টি স্থানে LSAT পরীক্ষা নেয়া হয়। বাংলাদেশের পার্শ্ববর্তী ভারতের গুরুগ্রামে দক্ষিণ এশিয়ার একমাত্র LSAT পরীক্ষার স্থান রয়েছে। যদিও বর্তমানে অনলাইনে ঘরে বসে LSAT টেস্ট দেয়ার সুযোগ রয়েছে।
অনলাইনে এই টেস্টের কোচিং সুবিধাও রয়েছে, তবে নন-নেটিভ বা ইংলিশ মিডিয়ামে না পড়া কারো সহজে বাংলাদেশ হতে চান্স পাওয়া কষ্টসাধ্য ও ব্যয়বহুল। LSAC তথা ল স্কুল এডমিশন কাউন্সিল এর মাধ্যমে টেস্ট দেয়ার কাজ সমাধা করা যায়, তবে কোচিং করতে কাপলান, ম্যানহাটন রিভিউ, LSAT সেন্টার, জুরিস এজুকেশন, ভার্সিটি টিউটর ইত্যাদি কোচিং সেন্টার অনালিনে কার্যক্রম চালায়। আর ৩ বছরের অধিক সময়ের এই JD করতে স্কলারশিপ বাদ দিলে বাংলাদেশি টাকায় ২-৩ কোটি টাকার বেশি খরচ হতে পারে। আমেরিকার সব স্টুডেন্টস JD করে সরকারের টাকায় লোন নিয়ে। দুনিয়ার সবচেয়ে দামি ডিগ্রি এটি। আমেরিকায় থেকে আমেরিকায় আন্ডারগ্রেড করে LSAT দিয়ে পাশ করে সরকারি লোন নিয়ে JD পড়তে পারা যায়। বাংলাদেশে পড়ুয়া যে কারো এই ডিগ্রি অর্জন কেবল স্বপ্নের মতো, শুধু.০৫% সফল হবে। আর হ্যাঁ, আপনি এ দেশে আইনে মাস্টার্স করলেন, বাবার কয়েক কোটি টাকার বেশি ব্যাংকে আছে, তাইলে আপনি আমেরিকায় এসে বছর কয়েক অবস্থান করে কোচিং করে LSAT দিয়ে JD করতে পারেন। এই ডিগ্রি হচ্ছে আমেরিকার জন্য গোল্ডেন গেট। সুযোগ আর সুবিধার অন্ত নেই।
দ্বিতীয়ত: এল এল এম করা। মাস্টার্স অব ল হচ্ছে সবার জন্য উন্মুক্ত একটি ডিগ্রি। বিশ্বের যে কোন দেশ হতে আইনে অনার্স থাকলেই এল এল এম এর জন্য আবেদন করা যায়। আজকে এই ডিগ্রি অর্জনের পদ্ধতি সবিস্তারে আলোচনা করব।
তৃতীয়ত: পিএইচডি তথা ডক্টর অব জুরিডিক্যাল সায়েন্স (SJD) করা। এই ডক্টেরেট ডিগ্রি এ দেশে তেমন কেউ করে না। যারা শিক্ষক হতে চায় তাদের একাংশ এই ডিগ্রি নিতে আবেদন। আবার সব ল স্কুলে এই ডিগ্রি অফারও করে না। হয় একটা JD বা মাস্টার্স প্লাস পাবলিকেশন থাকলে এই ডিগ্রির জন্য আবেদন করতে পারেন। পিএইচডি এর আবেদন প্রক্রিয়া সম্পূর্ণরূপে ল স্কুল গুলো নিজস্ব পদ্ধতিতে করে থাকে। তার জন্য ল স্কুল ও তদসংশ্লিষ্ট আইনের কোন প্রফেসরের সাথে যোগাযোগ করে তার অনুমোদন পেলেই কেবল পিএইচডি করা সম্ভব। এখানে কারো জুরিস ডক্টর করা থাকলে সহজে কেউ পিএইচডি করতে যায় না, জুরিস ডক্টরকে পিএইচডি সমমানের হিসেবে Quasi গণ্য করে।
উপরোক্ত ২য় ও ৩য় ক্ষেত্রে, আপনি বিশ্ববিদ্যলয়ে ভর্তি হতে, প্রফেসরের সাথে যোগাযোগ রক্ষা করতে, স্কলারশিপসহ জব জোগাড় করার নিমিত্ত আবেদনকারীর সুবিধার্থে প্রতিটি ইউনিভার্সিটির ওয়েবসাইটে সবার পরিচিতি, মোবাইল, ইমেইল, পাবলিকেশন সব দেয়া থাকে। এছাড়াও মাস্টার অব সায়েন্স, জুরিস মাস্টার ডিগ্রিও অফার করে থাকে।
এলএলএম এর আবেদন ধাপসমূহ চলুন আজ এসব বিষয়ে অল্প অল্প করে আলোচনা করা যাক। বিস্তারিত লিখতে গেলে ১০০ পৃষ্ঠার বই হয়ে যাবে। তারচেয়ে চলুন অল্প করে গল্প হোক।
১। পাসপোর্ট তৈরি করা: পাসপোর্ট তৈরি করা হচ্ছে একদম প্রাথমিক ধাপ। পাসপোর্ট ব্যতীত ভাষাগত পরীক্ষায় অংশগ্রহণ সম্ভব নয়। তাই যতদ্রুত সম্ভব পাসপোর্ট ও পুলিশ ক্লিয়ারেন্স করে ফেলা উত্তম। ই পাসপোর্ট সব দিক দিয়ে নিরাপদ। আইইএল্টিএস বা টোয়েফেল এর প্রস্তুতি নেয়ার সময়ই পাসপোর্ট এর আবেদন সম্পন্ন করা বুদ্ধিমানের কাজ। অবশ্য খেয়াল রাখবেন, পাসপোর্টের তথ্যের সাথে পরবর্তীতে প্রস্তুতকৃত সকল ডকুমেন্টস তথা এসওপির তথ্য, ব্যাংক সল্ভেন্সির তথ্য, সিভির তথ্য, যেন হুবহু মিল থাকে।
২। টোয়েফল বা আইইএলটিএস দেয়া: আমেরিকায় টোয়েফল, আইইএলটিএস বা ডুয়োলিংগো গ্রহণযোগ্য। আর এসব ইংরেজি জানার পরখ করে দেখার পরীক্ষাগুলো মোটামুটি খরচেরও বটে। আপনি যদি সরাসরি ইউনিভার্সিটির মাধ্যমে আবেদন করতে পারেন, তাহলে ডুয়োলিংগো বা পিটিই দিয়েই কাজ সমাধা করতে পারবেন। তবে আমেরিকান বার এসোসিয়েশন এর অনুমোদিত ল স্কুল এডমিশন কাউন্সিল এখনো আইইএলটিএস বা টোয়েফলকেই প্রাধান্য দিচ্ছে। আইইএলটিএস বা টোয়েফল স্কোর সরাসরি LSAC এর ইমেইলে প্রেরণ করবেন। আইইএলটিএস এ ৬.৫ এর উপরে থাকলে ভর্তির সম্ভাবনা ও স্কলারশিপ দুটিই সমানভাবে বাড়তে থাকে। ভাল জিপিএ এর চেয়ে ভাল স্কোর বেশি ভূমিকা রাখে ভাল ভাল ইউনিভার্সিটির ভর্তি ও স্কলারশিপ পেতে। এখানে বলে রাখা ভাল, আইনে স্কলারশিপ এর জন্য জিআরই স্কোর প্রয়োজন নেই। ল্যাঙ্গুয়েজ টেস্ট টা আগে দেয়া সমীচীন মনে করি। একে ত এর মেয়াদ ২ বছর পর্যন্ত থাকে, দুই বছর আপনি চিন্তামুক্ত, দ্বিতীয়ত, পরবর্তী ধাপের CV, LOR, SOP, essay ইত্যাদি সংগ্রহ ও প্রস্তুতে ভাল ইংরেজির দখল আপনাকে অনেক সুবিধায় রাখবে। আবার ইউনিভার্সিটির ফরেন এফেয়ার্স বিভাগের ইমেইলের সঠিক জবাব দিতেও সাহায্য করবে। নতুবা অন্য কারো সাহায্য নিতে হবে টাকার বিনিময়ে হয়ত। চেষ্টা করবেন কম্পিউটার বেইজড পরীক্ষায় বসার, কারণ আমেরিকায় পড়ালেখা সব কম্পিউটার সিস্টেমের মাধ্যমে হয়ে থাকে। হাতের লেখার সুযোগও যদিও বা আছে , তবে তা সীমিত এবং নাম্বার বেশি পাবার নিশ্চয়তা বহন করবে না।
৩। ডুয়েল কারেন্সি ক্রেডিট কার্ড জোগাড় করা: আমেরিকায় LSAT আবেদন, LSAT একাউন্ট খোলা, সনদ মূল্যায়ন করানো ইত্যাদি ক্ষেত্রে প্রচুর টাকা জমা দিতে হয়। আর তা ডলারে পেমেন্ট করতে হয়। আপনি যদি পেশাজীবী হন, নিজের নামেই ডুয়েল কারেন্সি ক্রেডিট বা ডেবিট কার্ড নিয়ে নেন। অনেক কাজে দিবে। আর যদি সদ্য পাশ স্টুডেন্ট হন, তাইলে অন্য কারো সহযোগিতা নিতেই হবে সব পেমেন্ট এ।
৪। LSAT একাউন্ট খোলা: আমেরিকায় ২০২ টি ইউনিভার্সিটি আছে যেগুলো আমেরিকান বার এসোসিয়েশন এর অনুমোদিত আইন পড়ানোর জন্য। এসব ল স্কুলে আবেদন করতে গেলে অবশ্য LSAC এর একাউন্ট খুলে তারপর আবেদন প্রক্রিয়া সম্পন্ন করতে হবে। একাউন্ট এ তথ্য দেয়ার ক্ষেত্রে সর্বোচ্চ সতর্কতা অবলম্বন করতে হয়। তাই প্রথমবার নিজে না করে অভিজ্ঞ কারো সহযোগিতা নিলেই সবচেয়ে ভাল। আমেরিকায় আইনের ভাল ভাল র্যাংকিং এর বিশ্ববিদ্যালয়ের নাম গুলো usnews or qsranking লিখে গুগলে সার্চ দিলে পেয়ে যাবেন, এরপর আবেদন ক্রাইটেরিয়া ও আপনার যোগ্যতা অনুসারে আবেদন আগাবেন।
৫। একাডেমিক ট্রান্সক্রিপ্ট প্রেরণ ও মূল্যায়ন: যে সব ইউনিভার্সিটিতে আপনি পড়তে আগ্রহী, সে সব ইউনিভার্সিটির ওয়েবসাইট এ বা গুগলে LLM for international student লিখে সার্চ দিলে দরকারি সকল তথ্য পেয়ে যাবেন। ওয়েবসাইট হতে জানতে পারবেন কি কি ডকুমেন্টস লাগবে আবেদন প্রক্রিয়া সম্পন্ন করতে, এবং সে অনুযায়ী দলিলাদি প্রস্তুত করবেন। সব ইউনিভার্সিটির আবেদনে চাহিত দলিল এক নয়। আর LSAT এ একাউন্ট সম্পন্ন করতে পারলে ল স্কুল এডমিশন কাউন্সিল ওয়েবসাইট আপনাকে সহজে লিড করবে। একাডেমিক ট্রান্সক্রিপ্ট এর জন্য প্রথমে LSAC এ এন্ট্রি করবেন, তারপর একটা কাভার লেটার আপনার জন্য প্রস্তুত হবে। সেটা প্রিন্ট করে নিবেন। আপনার নিজের ভার্সিটির বৈদেশিক শিক্ষা শাখায় গিয়ে একাডেমিক ট্রান্সক্রিপ্ট হয় LSAC বা অন্য যে কোন সনদ মূল্যায়ন প্রতিষ্ঠানে ডাকযোগে বা কুরিয়ারযোগে প্রেরণ করে মূল্যায়ন করে LSAC এ প্রেরণ করতে হবে। আমি এ ক্ষেত্রে আপনাদের পরামর্শ দিব, নির্দিষ্ট ফি এর বিনিময়ে LSAC এর ট্রান্সক্রিপ্ট ক্রিডেনশিয়াল ইভালুয়েশন সেবা ক্রয় করে, ভার্সিটি হতে LSAC এর ঠিকানায় প্রেরণে ব্যবস্থা নেয়। এটাই নিরাপদ, তবে এখানে সর্বোচ্চ সতর্কতা অবলম্বন জরুরী। মূলে মূল্য অত্যাধিক।
৬। সিভি তৈরি করা: কারিকুলাম ভিটায়ে বা সিভি হচ্ছে পড়াশোনার অতীত, বর্তমান ও ভবিষ্যত নির্ধারক। সিভি তৈরির জন দক্ষ কারো সহযোগিতা নেয়া আবশ্যক, গুগলে সার্চ দিলেও অনেক সিভির স্যাম্পল, টেমপ্লেটস পেয়ে যাবেন, সাথে অনেক টিপসও। সিভিতে কি কি তথ্য থাকবে, কি কি থাকবে না এসব জানা সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। সিভির ভাষা, প্রেজেন্টেশন অনেক গুরুত্ব বহন করে। এই সিভি আপনি LSAC এ আপলোড করবেন অবশ্য পরবর্তী বিভিন্ন ধাপে।
৭। Letter of recommendations (LOR) সংগ্রহ করা: সিভির পরবর্তী ধাপ হচ্ছে লেটার অব রিকোমেন্ডেশন নেয়া। কমপক্ষে ২ টা LOR দরকার পড়ে, বেশিরভাগ ল স্কুল ৩ টা রিকমেন্ডেশন লেটার চেয়ে বসে। হতে পারে তা দুজন আপনার ইউনিভার্সিটির শিক্ষক আর একটা কর্মক্ষেত্রের বসের নিকট হতে। তবে যদি সদ্য পাশ হন তবে, তৃতীয় LOR সিনিয়র আইনজীবী বা ল ফার্ম বস বা শিক্ষক বা জজ বা ম্যাজিস্ট্রেট হতেও নিতে পারেন। LOR পেতে গেলে আগে অবশ্য LSAC এ রিকমেন্ডারের তথ্য ফিলাপ করতে হয়, তারপর LSAC রিকোমেন্ডারের ইমেইলে একটা লিংক পাঠাবে, রিকোমেন্ডার সেই লিংক এ ক্লিক করে LSAC এ একটা একাউন্ট খুলে আপনার তথ্য ইনপুট ও আপলোড করবে। LSAC আপনাকে জানাবে কি কি তথ্য দিতে হবে, না হয় অভিজ্ঞ কারো হেল্প নিবেন। তার আগে রিকমেন্ডারের সাথে ইমেইলে যোগাযোগ করে উনার কাছে জিজ্ঞেস করে নিবেন উনি দিতে পারবেন কি না বা উনি এভাইলএভেল আছেন কি না। নতুবা অনিচ্ছাকৃত কালক্ষেপন হতে পারে। যদি উনি হ্যাঁ বলেন, সাথে সাথে উনাকে আপনার সিভি প্রেরণ করবেন, এবং LSAC এ উনার তথ্য প্রবেশ করবেন। LOR গৃহীত হলে আপনার মেইলে তার তথ্য প্রকাশ করবে LSAC। আপনার একাউন্ট কতটুকু সম্পন্ন হলো তা দেখতে পাবেন। ১০০% সম্পন্ন না হলে আপনি কোন ইউনিভার্সিটিতে আবেদন করতে পারবেন না। তাই সময় নিয়ে, বুঝে শুনে, অভিজ্ঞ কারো সহযোগিতা নিয়ে একাউন্ট সম্পন্ন করার চেষ্টা করবেন।
৮। Statement of Purpose (SOP) বা essay তৈরি করা: একাউন্ট সম্পন্ন হলে পরে বিভিন্ন ইউনিভার্সিটি নাম সার্চ দিবেন LSAC এ এবং আবেদন করার নিয়ম কানুন ফি বিষয়ক তথ্যাদি পেয়ে যাবেন। এখানে উল্লেখ্য, আবেদনের ক্ষেত্রে আপনাকে বেশিরভাগ ল স্কুলে SOP তথা স্টেট্মেন্ট অব পারপাস আপলোড করতে হবে, অনেকক্ষেত্রে একটা ছোট essay লিখে দিতে হয়। দুটোই মূলত একই সূত্রে গাথা, নাম ভিন্ন। এই এস ও পি এবং essayর উদ্দেশ্য হচ্ছে আপনি যে তথ্য সিভিতে মন খুলে বলতে পারেন নাই, তাই এখানে এক পৃষ্টা বা দুই পৃষ্টায় লিখে দিবেন। এই এস ও পি বা essay কত পৃষ্টার হবে তা LSAC এ পাবেন না, সংশ্লিষ্ট ল স্কুলের ওয়েবসাইটে প্রয়োজনীয় তথ্যের ভিড়ে পাবেন। এস ও পি তে সংক্ষিপ্তসারে আপনার পরিবার পরিচিতি, শিক্ষা জীবনের চড়াই-উতরাই, কর্মজীবনের শিক্ষা ও তার ভবিষ্যৎ ক্যারিয়ার, উদ্দেশ্য, যেখানে পড়তে যাচ্ছেন তার সম্পর্কে তথ্য , কেন যাচ্ছেন এবং পড়ে কি করবেন প্রভৃতি তথ্যদি লিপিবদ্ধ করবেন। এস ও পি কে বলা হয় আবেদনের সার। এটার ভাষার আবেদন, প্রাঞ্জলতার উপর আপনার ভর্তি ও স্কলারশিপ প্রাপ্তি অনেকাংশে নির্ভরশীল, এমনকি এটা ভিসা প্রাপ্তিতেও ভাল কাজে দেয়। তাই এস ও পি বা essay নিজে লিখে অভিজ্ঞ কাউকে দিয়ে প্রুফ রিড করে নেয়া উত্তম, নতুবা অভিজ্ঞ দিয়ে লিখে নেয়া।
৯। ব্যাংক স্টেটমেন্ট বা সলভেন্সি সনদ সংগ্রহ করা: বিশ্বের অন্যান্য দেশে পড়তে যাবার জন্য সম্পত্তির মূল্যায়ন, জমিজমার দলিলাদি জমা দিতে হয় ব্যাংক সল্ভেন্সির পাশাপাশি। কি এক আশ্চর্য্য জাদুমন্ত্র বলে আমেরিকা এ বিষয়ে বেশ শীতিলতা প্রদর্শন করছে! ব্যাংক সনদ, সল্ভেন্সি ও স্টেট্মেন্ট একটা গুরুত্বপূর্ণ দলিল ল স্কুল ভর্তির আই-২০ পাওয়া ও এম্ব্যাসিতে ভিসা পাওয়াতে। মনে রাখবেন, এসব দলিলাদি আপনি as of right পাবেন না, এটা সম্পূর্ণ ল স্কুল ও এম্ব্যাসীর বিচার বিবেচনার (discretion) এর উপর ছেড়ে দেয়া হয়েছে। আই-২০ পেলেই যে ভিসা পাবেন, ভিসা পেলেই যে যেতে পারবেন তা কিন্তু না। প্রতিটি ধাপ বুঝে শুনে ধৈর্য্য ধরে সততার নীতিতে এগুতে হতে। আমেরিকার বিশ্ববিদ্যালয় ও এম্ব্যাসী জমিজমার কাগজ দেখে না, শুধু ব্যাংক সনদ চাইতে পারে। বাংলাদেশে বর্তমানে বেশ কিছু বেসরকারী ব্যাংক এই সনদ ও লোন সল্ভেন্সি পেতে অনির্দিষ্ট ফির বিনিময়ে সহযোগিতা করে থাকে। এ ক্ষেত্রে নিজেই স্ট্যান্ডার্ড, এইচ এস বিসি, আইবিবিএল, গ্লোবাল ব্যাংক যেগুলো আছে তার ম্যানেজারের সাথে কথা বলে নিতে পারেন। অথবা অভিজ্ঞ কারো সহযোগিতা নিতে পারেন। ব্যাংক সল্ভেন্সি অবশ্য একাউন্ট হোল্ডারের আয়, ব্যবসার সাথে যেন সামঞ্জস্য হয়। অযৌক্তিক মনে হলে ভর্তি-ভিসা কোনটাই না পাবার সম্ভাবনা বেশি।
১০। ইউনিভার্সিটির ওয়েবসাইট ঘেটে সুবিধাজনক প্রতিষ্ঠানে আবেদন করা: চলুন এবার আবেদন শুরু করা যাক। ইতোপূর্বে আপনি বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের ওয়েবসাইট থেকে জেনে গিয়েছেন কোন আপনার জন্য ভাল হবে এবং আপনার LSAC একাউন্ট পরিপূর্ণ হলো। আপনার পছন্দের ল স্কুল LSAC এ সার্চ দিয়ে আবেদন কার্যক্রম শুরু করুন। যা যা তথ্য লাগে ইনপুট দিন। এসওপি আপলোড করুন। LOR গুলো এড করে দিন। এ ক্ষেত্রে খেয়াল রাখবেন, কিছু ল স্কুলে আবেদনে পেমেন্ট করতে হয়, কিছু ল স্কুলে করতে হয় না। খরচ করবেন আপনার সামর্থ্য অনুসারে। ডলার থাকলে করবেন না থাকলে করবেন না। আমেরিকার কোন ল স্কুল খারাপ না, শুধু মানে ও শিক্ষকে যা একটু পার্থক্য। আরেকটি বিষয়, যে সব ল স্কুলে আবেদন করছেন সেখানের আবহাওয়া, বাঙ্গালীর অবস্থান, খাবার দাবার, আপনার খুব নিকট আত্মীয় স্বজনের কাছে যাতায়ত সময়, থাকা খাওয়া খরচ অগ্রীম বিবেচনায় নিলে অনেকটা উপকার পাবেন। আমেরিকায় ইন স্টেট , আউট স্টেট টিউশন ফি ও খরচ এর বিষয় আছে। শুধু মনে রাখবেন, ইন স্টেট আপনার জন্য প্রযোজ্য নয়। দ্রব্য মূল্যের উর্ধ্বগতির এ দেশে প্রতি মাসে থাকা খাওয়া বাবদ প্রতি মাসে নিদেনপক্ষে প্রতিজন ৭০০-১২০০ ডলার খরচ হতে পারে। প্রথম ২-৩ মাসের টাকা আপনাকে নিয়ে আসতে হবে, পরবর্তীতে অন ক্যাম্পাস জব পেলে তা অনেকটা পুষিয়ে নিতে পারবেন। প্রাথমিক অবস্থায়, নতুন পরিবেশে অনেকের কষ্ট বেশি হয়। সবকিছু নিজেকেই করতে হয়। এমনকি রান্নার কাজও। বাংলাদেশের স্বাদের রান্না, বাসায় প্রস্তুত খাবার আমেরিকায় পাবেন না এটা মাথায় রেখেই দেশত্যাগ করবেন। অবশ্য, দেশে রান্নার বেসিক শিখে যাবেন।
১১। ইউনিভার্সিটি থেকে এডমিশন ও স্কলারশিপ সংগ্রহ: ল স্কুলে আবেদন শেষে অপেক্ষা ভর্তি ও স্কলারশিপের ইমেইলের। একবার ইমেইল পেয়ে গেলে আপনার আর LSAC এর কাজ আপাতত নাই। এরপর বিশ্ববিদ্যালয়ের নিজস্ব ইমেইল, ওয়েবসাইট, আইডি পাসওয়ার্ড এ যোগাযোগ হবে। একবছরে কত টাকা টিউশন ফি, কত স্কলারশিপ দিল এবং কত আপনাকে পে করতে হবে, থাকা খাওয়া বাবদ কত যাবে, যাতায়ত সুবিধা কেমন ইত্যাদি আগে ভাগে জেনে নিবেন। গুগলে নির্দিষ্ট স্কুলে cost of attendence লিখে সার্চ দিয়ে সে অনুযায়ী ব্যবস্থা গ্রহণ করবেন। আরেকটা বিষয়, আমেরিকায় আইনে মাস্টার্সে ফুলব্রাইট স্কলারশিপেরও ব্যবস্থা আছে। তবে তা খুব সামান্য। এতদ বিষয়ে জানার জন্য, ইউএস এম্ব্যাসীর ফেসবুক পেজ, ওয়েবসাইটে নিয়মিত ঢুঁ মারতে পারেন। বিশ্বের অনেক দেশ হতে অনেক ছাত্র ছাত্রী ফুলব্রাইট স্কলারশিপ নিয়ে যায়। মনে রাখবেন, আমেরিকা ডাইভার্সিটির দেশ। সে দেশে পড়াশোনায় যত বিভিন্ন দেশের স্টুডেন্টসকে ওরা এডমিশন দিতে পারে তত ভাল ভার্সিটি বলে র্যাংকিং এ জায়গা নেয়, অনুদান পায়, শিক্ষক বা ডিরেকটর এ বিষয়ে জড়িত ওরা প্রমোশন পায়। বিশ্ববিদ্যালয় নিজের স্বার্থেই চায় যে বাংলাদেশের মতো দেশের স্টুডেন্টসরা তাদের ল স্কুলে আবেদন করুক। তাই বাংলাদেশ থেকে আবেদনে, স্কলারশিপ আদায়ে আলোচনা, অন্যান্য সুবিধাদির কথোপকথন করে নিলেও অনেকাংশে সুবিধা পাওয়া যায়।
১২। I-20 নেয়া, DS-160 ফর্ম ফিলাপ, ভিসার জন্য আবেদন করা, ইন্টারভিউ ফেস করা এবং ভিসা সংগ্রহ করে উড়াল দেয়া: এখন আপনি আই-২০ পেয়ে গেলেন। আই-২০ হলো ভর্তির ফাইনাল কাগজ যা আপনার সাথে জুড়ে থাকবে গ্রেজুয়েশন সনদ ও গ্রিণ কার্ড পাওয়া পর্যন্ত (যদি থেকে যেতে চান)। আই-২০ তে আপনার তথ্য, ল স্কুলের তথ্য, কি পড়বেন, কত টাকা খরচ হবে, কত বছর পড়তে পারবেন এসব থাকে। আই-২০ এর তথ্য পরিবর্তনশীল, ভুল হলে দেশ হতে সংশোধন করতে পারবেন ভিসার আবেদন করার আগেই। কোন কিছু পরিবর্তন, পরিবর্ধন করতে হলে তার জন্য আপনাকে আমেরিকার বিশ্ববিদ্যালয়ে আসতে হবে, ভর্তি হতে হবে, থাকতে হবে, প্রয়োজন প্রদর্শন করে তার আনুপাতিক পরিবর্তন করে নতুন আই-২০ও নেয়া যায় শর্তসাপেক্ষ। আই-২০ পাবার পর, ভিসার জন্য এম্ব্যাসী ফেস করার আবেদন সম্পন্ন করতে হবে, এরপর ডিএস-১৬০ ফিলাপ করতে হবে, ইন্টারভিউ এর তারিখ নিয়ে ফেস করতে হবে। সে আরেক সমুদ্রসম কর্ম। এখানে কাজের চেয়ে দুশ্চিন্তা বেশি কাজ করে। এতদিন যে কষ্ট করে এসেছেন তা এক নিমিষেই না হাওয়ায় মিশে যায়! তাই ডিএস-১৬০ ফিলাপ এত বেশি সতর্কতার সাথে করতে হবে যে যেন তা আপনার জীবনের শেষ কাজ। এটা দিয়ে আপনার ভিসা পাওয়া, গ্রিণ কার্ড, সিটিজেনশিপ পাওয়া, আপনার ডিপেন্ডেন্টসদের ভবিষ্যৎও জড়িয়ে থাকে।
আমেরিকায় আইনে মাস্টার্স শেষ করে একবছরের জন্য OPT(Optional Practical Training) করতে পারবেন আইন সংশ্লিষ্ট কোন ফার্ম বা প্রতিষ্ঠানে। অবশ্য তার জন্য আপনাকে আগে একটা অফার লেটার নিতে হবে কোন চাকরির প্রতিষ্ঠান থেকে এবং আপনার বিশ্ববিদ্যালয়ের ইন্টারন্যাশনাল এফেয়ার্স এর সাথে যোগাযোগ করলে ওরা প্রয়োজনীয় কাগজ কার্যাদি সম্পন্ন করে দিবে। উক্ত ওপিটি এর সময়ে আপনি এটর্নি পরীক্ষায় অংশগ্রহণের আবেদন ও অংশগ্রহণ করতে পারবেন। এটর্নী এট ল এর পরীক্ষায় পাস করে, যে কোন একটা বারে এডমিট নেয়ার শুরু থেকে শেষ সে আরেক মহাযজ্ঞ। অন্য কোন দিন অন্য কোন লেখায় তা প্রকাশ করা যাবে। তবে এটুক বলতে পারি, সে অনেক অরডিলের মধ্য দিয়ে পাড়ি দিতে হয় এটর্নী এট ল হতে।
কমন ল ভুক্ত দেশের আইনের স্টুডেন্টস এর জন্য কিছুটা ছাড় রয়েছে আবেদন প্রক্রিয়ায়, স্টেট ভিত্তিক বার এ। সিভিল ল দেশের আইনের ছাত্ররা এ ক্ষেত্রে একটু বেশি কষ্ট করে থাকে। এ ক্ষেত্রেও বাংলাদেশের ছাত্রদের সম্ভাবনা ফেলনা নয়। পরিশেষে বলব, হারার আগে হারবেন না। একটা আমেরিকান ডিগ্রি আপনার দশ দিগন্ত উন্মুক্ত করে দিতে পারে। আপনার মনের, কাজের আকাশ অনেক বিশাল করে দিতে পারে। আমরা নেগেটিভিটিতে যাব না, পজিটিভ থাকবো, সৎ থাকবো। অন্যদিকে, প্রাপ্তিতে-অপ্রাপ্তিতে যেন কারো আকাশ ভেঙ্গে না পড়ে। মনে রাখবেন, আমেরিকায় গিয়ে অধিকাংশ কিন্তু পড়াশোনা শেষ করতে পারে না। প্রচুর পড়াশোনা ও অনবরত কাজের ভিতর হাবুডুবু খেতে চাইলে আমেরিকায় পড়তে যাবেন।